কাত্যায়নী দেবীর পৌরাণিক উপাখ্যান

পৌরাণিক উপাখ্যান

প্রাচীন কিংবদন্তি অনুযায়ী, দেবী কাত্যবংশীয় ঋষি কাত্যায়নের কন্যারূপে জন্মগ্রহণ করে কাত্যায়নী নামে পরিচিতা হন। মতান্তরে, কালিকা পুরাণে বলা হয়েছে, ঋষি কাত্যায়ন প্রথম দেবীর পূজা করেন; তাই তিনি কাত্যায়নী নামে অভিহিতা হন। আবার অপর একটি মতে, তিনি দুর্গা বা শিবের পত্নী পার্বতীর রূপান্তর। নবরাত্রি উৎসবে তাঁর পূজা প্রচলিত।বামন পুরাণ গ্রন্থে দেবী কাত্যায়নীর উদ্ভবের কাহিনি বিস্তারিতভাবে বর্ণিত হয়েছে: “দেবগণ চরম দুরবস্থায় বিষ্ণুর নিকট সহায়তা প্রার্থনা করলে, বিষ্ণু ও তাঁর আদেশে শিব, ব্রহ্মা ও অন্যান্য দেবগণের চক্ষু হতে দিব্য তেজ বিনির্গত হয়ে এক জ্যোতিপর্বতের সৃষ্টি করল। এই জ্যোতিপর্বত ধারণ করল অষ্টাদশভূজা, কৃষ্ণকেশী, ত্রিনয়না ও সহস্র সূর্যের প্রভাযুক্তা দেবী কাত্যায়নীর রূপ। শিব তাঁকে ত্রিশূল প্রদান করলেন। বিষ্ণু দিলেন সুদর্শন চক্র, বরুণ দিলেন শঙ্খ, অগ্নি দিলেন শক্তি, বায়ু দিলেন ধনুক, সূর্য দিলেন তীরভরা তূণীর, ইন্দ্র দিলেন বজ্র, কুবের দিলেন গদা, ব্রহ্মা দিলেন অক্ষমালা ও কমণ্ডলু, কাল দিলেন খড়্গ ও ঢাল এবং বিশ্বকর্মা দিলেন কুঠার ও অন্যান্য যুদ্ধাস্ত্র। এইভাবে অস্ত্রসজ্জিতা হয়ে দেবী গেলেন বিন্ধ্যাচলে। সেখানে চণ্ড ও মুণ্ড অসুরদ্বয় তাঁকে দেখে তাঁর রূপে মুগ্ধ হয়ে তাদের রাজা মহিষাসুরের নিকট দেবীর রূপ বর্ণনা করেন। মহিষাসুর দেবীকে লাভ করবার জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠে। সে দেবীর পাণিপ্রার্থনা করে। দেবী জানান, তাঁকে লাভ করতে হলে তাঁকে যুদ্ধে পরাস্ত করতে হবে। মহিষাসুর যুদ্ধ করতে এলে দেবী সিংহপৃষ্ঠে আরোহণ করে যুদ্ধ করেন। মহিষাসুর মহিষের রূপ ধরে দেবীকে আক্রমণ করলে, দেবী তাঁকে তীব্র পদাঘাত করেন। দেবীর পদাঘাতে মহিষাসুর অচৈতন্য হয়ে মাটিতে পড়ে গেলে দেবী তার মস্তক ছিন্ন করেন। এইভাবে দেবী কাত্যায়নী মহিষাসুরমর্দিনী নামে অভিহিতা হন।” বরাহ পুরাণ ও দেবীভাগবত পুরাণ গ্রন্থেও এই কাহিনির উল্লেখ রয়েছে।তন্ত্র অনুসারে, শিবের ছয় মুখের মধ্যে উত্তর মুখ থেকে দেবী কাত্যায়নীর উদ্ভব। এই মুখ নীলবর্ণ এবং ত্রিনয়ন। দক্ষিণাকালী, মহাকালী, গুহ্যকালী, শ্মশানকালী, ভদ্রকালী, একজটা, উগ্রতারা, তারিণী, ছিন্নমস্তা, নীল সরস্বতী, দুর্গা, জয়দুর্গা, নবদুর্গা, বাশুলী, ধূমাবতী, বিশালাক্ষী, গৌরী, বগলামুখী, প্রত্যাঙ্গীরা, মাতঙ্গী ও মহিষাসুরমর্দিনী দেবী এবং তাঁদের মন্ত্র ও পূজাপদ্ধতির উদ্ভবও হয় এই মুখ থেকেই।

বেদের অন্য একটি উপাখ্যান অনুযায়ী, কাত্যায়নী ও মৈত্রেয়ী ছিলেন ঋষি যাজ্ঞবল্ক্যের দুই স্ত্রীর নাম। কথিত আছে, ঋষি যাজ্ঞবল্ক্য শতপথ ব্রাহ্মণের রচয়িতা।


মায়ের মূর্তিতত্ত্ব



মায়ের মূর্তিতত্ত্বঃ
মূর্তিতত্ত্ব তন্ত্রসারে বর্ণিত ধ্যানমন্ত্রে কাত্যায়নীকে দশভূজা মহিষাসুরমর্দিনীর রূপেই বর্ণনা করা হয়েছে:

সব্যপাদসরোজেনালঙ্কৃতোরুমৃগাধিপাম্।
বামপাদাগ্রদলিতমহিষাসুরনির্ভরাম্।।
সুপ্রসন্নাং সুবদনাং চারুনেত্রত্রয়ান্বিতাম্।
হারনূপুরকেয়ূরজটামুকুটমণ্ডিতাম্।
বিচিত্রপট্টবাসামর্ধচন্দ্রবিভূষিতাম্।।
খড়্গখেটকবজ্রাণি ত্রিশূলং বিশিখং তথা।
ধারয়ন্তীং ধনুঃ পাশং শঙ্খং ঘণ্টাং সরোরুহাম্।
বাহুভির্ললিতৈর্দেবীং কোটিচন্দ্রসমপ্রভাম্।।

-যিনি দক্ষিণ পাদপদ্ম দ্বারা বিরাট মৃগাধিপতিকে (সিংহ) অলঙ্কৃত করে বাম পদের অগ্রভাগ দ্বারা মহিষাসুরকে বিদলিত করছেন; যিনি সুপ্রসন্না ও সুন্দর বদনযুক্তা; যাঁর তিনটি নেত্রই মনোহর; যিনি হার, নূপুর, কেয়ূর ও জটামুকুটাদিতে শোভিতা; যাঁর পরিধানে বিচিত্র পট্টবস্ত্র এবং কপালে অর্ধচন্দ্র; যিনি সুকোমল দশ বাহুতে খড়্গ, খেটক, বজ্র, ত্রিশূল, বাণ, ধনুক, পাশ, শঙ্খ, ঘণ্টা ও পদ্ম ধারণ করে থাকেন; যাঁর দেহপ্রভা কোটি চন্দ্রের ন্যায়… [সেই দেবীকে ধ্যান করিবে]।
হরিবংশ গ্রন্থে দেবী অষ্টাদশভূজা। এই গ্রন্থে বর্ণিত মূর্তিটি নিম্নরূপ:

অষ্টাদশভূজা দেবী দিব্যাবরণভূষিতা।
হারশোভিতাসর্বাঙ্গী মুকুটোজ্জ্বলভূষণা।।
কাত্যায়নী স্তূয়সে ত্বং বরমগ্রে প্রযচ্ছসি।

—অষ্টাদশভূজা, দিব্যাবরণভূষিতা, সর্বাঙ্গে হারশোভিতা, উজ্জ্বল মুকুট ভূষণা দেবী কাত্যায়নী আপনার স্তব করি, আমাকে বর প্রদান করুন।


« Newer EntriesOlder Entries »